ফেইসবুক পেইজ বুস্টিং, গুগল প্লে-স্টোর, কিংবা নেটফ্লিক্স এর সাবস্ক্রিপশন কেনা, সবকিছুতেই এখন বাংলাদেশীরা ডুয়েল কারেন্সি প্রিপেইড, ডেবিট এবং ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করতে পারছেন। আমাদের জন্য এটা অনেক বড় একটা খুশির বিষয়। একটা সময় শুধু পেপাল আর পেওনিয়ারের দিকেই চেয়ে বসে থাকতে হতো হা-করে।
আজকে নিজের অভিজ্ঞতার কথা বলব দেশের স্বনামধন্য দুই ব্যাংক সিটি ব্যাংক লিমিটেড এবং ইষ্টার্ন ব্যাংক লিমিটেড (ইবিএল) এর কার্ড নিয়ে।
সিটি ব্যাংকের একাউন্ট আমার অনেক পুরনো। তাদের সিটিম্যাক্স কার্ড যেটা সেইভিংস একাউন্টের সাথে দেয়া সেটা অনেক আগে থেকে ব্যবহার করলেও ডুয়েল কারেন্সি সুবিধা প্রথম দিকে পাইনি। তাদের কলসেন্টারও তখন একাধিকবার নিশ্চিত করেছিল এটি ডুয়েল কারন্সি কার্ড নয়।
হতাশ আমি তখনও পেওনিয়ার, পেপাল আর আরেকটা ইন্টারন্যশনাল ভিসা কার্ড দিয়ে কাজ চালিয়ে নিচ্ছিলাম। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে এগুলোতে ডলার সবসময় পর্যাপ্ত থাকত না। আর ডলার কিনতে গেলে উচ্চমূল্য দিতে হত।
সিটিম্যাক্স ডুয়েল কারেন্সি কার্ড
২০২০ এর শেষের দিকে এসে সিটি ব্যাংকের সিটিমেক্স যে ডুয়েল কারনেসি তা নিশ্চিত হই এবং পাসপোর্ট নিয়ে গিয়ে সেটা এন্ডোর্স করে নিয়ে আসি চার হাজার ডলারের সমপরিমানে। মানে এই কার্ড দিয়ে ফান্ড থাকা সাপেক্ষে আমি বছরে চার হাজার ডলার অনলাইনে বা অফলাইনে খরচ করতে পারবো।
গুগল প্লে-স্টোরে কার্ড এড করতে গিয়ে প্রথমবার পারিনি। তাই একটু গুগল আর ফেইসবুক গ্রুপগুলোতে ঢু-মেরে জানতে পারলাম আমার পেমেন্ট প্রোফাইলে রিজিওন পরিবর্তন করে USA দিতে হবে। কারন সেটা না করলে প্লে-স্টোরে টাকায় দাম দেখায় যেটা এই সিটিম্যাক্স কার্ড দিয়ে পেমেন্ট করা যাবে না।
অদ্ভুত!… অথচ ডাইনামিক কারেন্সি অটো কনভার্ট হয়ে যাচ্ছে টাকা থেকে ইউএসডিতে, কিন্তু রিজিওন পরিবর্তন মানে পেমেন্ট প্রোফাইল আমেরিকান না হলে সিটিম্যাক্স কার্ড কাজ করছে না। করলাম সেটা, এবার সব মাখনের মত কাজ করছে। প্লে-স্টোর থেকে গেইম কেনা, নেইমচিপে পেমেন্ট করা এবং নেটফ্লিক্সে সাবস্ক্রিপশন কেনা, ফেইসবুক পেইজ বুস্ট করা সবই করতে পারছি।
কিন্তু কিছু সমস্যাও রয়েছে সিটিম্যক্স কার্ডের। এদের কলসেন্টারে ফোন করে আপনার বলে দিতে হয় ঠিক কত ডলার আপনি খরচ করতে চান আর কয়বার পেমেন্ট করতে চান। এরা সেটার একটা আমাউন্ট সেট করে দেবে সাথে ট্রানজেকশন নাম্বার। এটা নাকি সিকিউরিটি পারপাস করতে হয়। এটার সাথে এন্ডোর্সমেন্টের এমাউণ্টের কোন রিলেশন নেই।
অদ্ভুত নিয়ম…! আমি ৩০০ ডলার আর ১০০ ট্রানজেকশন নাম্বার সেট করে রেখেছি। এই পরিমান ডলার খরচ করার পর বা এতবার ট্রানজেকশন করার পর আবার ফোন দিয়ে এটা রিসেট করে নিতে হবে। কার্ড কোথাও এড করলে বা ডিক্লাইন হলেও ১ বার ট্রানজেকশন হয়েছে বলে ধরা হয়।
সিটিম্যাক্স কার্ড দিয়ে ফেইসবুক পেইজ বুস্ট করতে গেলেও আপনাকে USD তে একটা পেমেন্ট প্রোফাইল করতে হবে যেটাতে এডের খরচ ডলারে দেখাবে। টাকায় দেখালে এই কার্ড দিয়ে বাংলাদেশ থেকে পেমেন্ট করতে পারবেন না।
তবে নেইমচিপে বা নেটফ্লিক্সে কার্ড ব্যবহার করতে কোন সমস্যায় পড়তে হয়নি কারন তারা সব কিছুর দাম USD তেই নিয়ে থাকে। সমস্যা হয় সে সকল জায়গায় যেখানে দাম দেখায় টাকায় কিন্তু পেমেন্ট নিতে চায় USD তে।
ইন্ডিয়াতে মেডিক্যাল এপয়ন্টমেন্ট নিতে গিয়ে পড়লাম ঝামেলায়। তাদের গেটওয়ে এমেক্স কার্ড সাপোর্ট করে না। ফলাফলঃ – আবার পেওনিয়ারের ব্যবহার করে কাজ সারা।
এমেক্সের এই ঝামেলায় অনেকবার পড়তে হয়। লোকাল অনেক শপও এমেক্স কার্ড দেখলে তাদের পজ মেশিন লুকিয়ে ফেলে। তবে আপনার প্রথম টার্গেট যদি থাকে অনলাইনে ইন্টারন্যশনাল পার্চেজ করা তবে সমস্যা হবার কথা না।
থিমফরেস্ট বিড়ম্বনাঃ
থিমফরেস্ট থেকে থিম কিনতে গিয়ে পড়লাম মহা মুসিবতে। আমি আমারে এমেক্স ক্রেডিট কার্ড দিয়ে পেমেন্ট করতে গেলাম সাথে সাথে একাউন্ট সাসপেন্ড। সাপোর্টে মেইল দিলে একাউন্ট ঠিকি ওপেন করে দিল কিন্তু একাউন্ট থেকে কার্ড পেমেন্টের অপশন সরিয়ে দিল। মনে হল বাংলাদেশ থেকে পেমেন্ট করাটাই অপরাধ হয়েছে। অথচ আমি নিজের ক্রেডিট কার্ড দিয়েই পেমেন্ট করেছিলাম।
আমাকে বলা হল পেপাল দিয়ে পেমেন্ট করতে। শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়ে অন্য আরেকজনের কাছ থেকে পেপাল ডলারে জোগাড় করে সেটা দিয়ে পেমেন্ট করি।
ইবিএল ভিসা ক্লাসিক কার্ড
ফেইসবুকে ব্যাংক কার্ড ইউজার গ্রুপে দেখলাম ইবিএল নিয়ে প্রচুর পরিমানে নেগেটিভ রিভিউ। তারপরেও আমি মনস্থির করি ইবিএল এ একটা সেইভিংস একাউণ্ট করে তাদের ভিসা ক্লাসিক কার্ডটা নেব। কারন এটা ডুয়েল কারনেসি আর এমেক্স নিয়ে আমি সন্দিহান অনেক জায়গাতেই পেমেন্ট করতে সমস্যায় পড়ায়।
চলে গেলাম ছবি আর প্রয়োজনীয় কাগজ নিয়ে ধানমন্ডি সাত-মসজিদ রোডের ইবিএল ব্রাঞ্চে। কোনরকম সমস্যা বাদেই ঘন্টাখানেক সময় ব্যায় করে একটা একাউন্ট খুলে ফেললাম। তাদের ব্যবহার যতটা খারাপ বলে অনলাইনে পড়েছিলাম সেরকম কিছুই দেখলাম না। তবে অন্য জায়গায় একাউণ্ট ওপেনিং ফর্ম ব্যাংক অফিসারই ফিলাপ করে দেয়, এখানে সেটা আমি নিজেই ফিলাপ করেছি।
এর সপ্তাহ খানেক পরে আবার এসে কার্ড আর চেকবুক নিয়ে এলাম, সেইসাথে এন্ডোর্সও করিয়ে নিয়ে আসলাম এটাতে দুই হাজার ডলার সমমানের। কিন্তু তখনো কার্ড একটিভ করা হয়নি। ব্রাঞ্চের সবার মাঝে আন্তরিকতার কমতিও আমি দেখিনি।
আমার লেনদেন এর ৯০ ভাগ অনলাইনেই হয় দেখে আমি ব্যাংকে বেশি যাইও না। তাই কোন ব্যাংকের ব্রাঞ্চের এমপ্লয়িদের ব্যবহার খারাপ শুনলে আমি একটু অবাক হই, অভিজ্ঞতা কম। কার্ড নিতে বা একাউন্ট করতে আমি সময় নিয়ে যাই, কারন সেখানে আমি একলাই কাস্টমার নই।
হেল্পলাইনে ফোন দিয়ে কার্ড একটিভ করতে বললাম, পিন সেটাপ করলাম। আমাকে জানানো হয়েছিল ২৪ ঘন্টা সময় লাগবে, কারন ব্রাঞ্চ থেকে ইন্সট্রাকশন এখনও আপডেট করা হয়নি।
২৪ ঘন্টা লাগেনি তার আগেই কার্ড একটিভ করা হয়েছে। আমি প্লে-স্টোরে এড করতে গিয়ে প্রথমবার পারিনি, পরে নেটফ্লিক্সে এড করলাম কোন সমস্যা বাদেই। আবার প্লে-স্টোরে এড করার সময় ঠিকানা সহ সব কিছু দিলাম বাংলাদেশের, এবার সুন্দরভাবেই এড হয়ে গেল।
আমার পেমেন্ট রিজিওন কিন্তু এখনও USA দেয়া। কিন্তু কার্ড এড করেছি দেশের এড্রেস দিয়েই।
কার্ড এড করলে যে টেস্টিং ১ ডলারের মত চার্জ কাটে সেটা আবার সাথে সাথেই কার্ডে ফেরত দিয়েছে। অথচ সিটিম্যাক্স কার্ডে এই টাকা আমি ফেরত পাইনি। মনে হয় এটার জন্য আবার কলসেন্টারে কল করে অভিযোগ করতে হয়।
ইবিএল এর কল সেন্টারে ফোন করে আমাকে ট্রানজেকশন নাম্বার বা এমাউন্ট সেট করতে হয়নি। সব কিছু সাধারনভাবেই হয়ে যাচ্ছে কার্ড একটিভ করার পর। তবে ব্যাংক থেকে আমাকে বলে দিয়েছে ৩০০ ডলারের বেশি পেমেন্ট করতে হলে কলসেন্টারে ফোন করে আগে থেকে বলে দিতে।
সব কিছু বিচারে ডুয়েল কারেন্সি পেমেন্ট করতে গেলে আমি ইবিএল এর এই কার্ডকে সিটিম্যাক্স কার্ড থেকে এগিয়ে রাখব।
কিছু নোটঃ
০১. আমি সিটিম্যাক্স এবং ইবিএল ভিসা ক্লাসিক কার্ড নিয়েছি সেইভিংস একাউন্টের বিপরীতে। এতে ডলার কনভার্সন এর ঝামেলা নাই। একাউন্টে টাকা থাকলেই তা থেকে ডলারে খরচ করা যায়।
০২. প্রি-পেইড কার্ডে আলাদা ভাবে ডলার লোড করতে হয় বা টাকা লোড করে ডলার কনভার্সান রিকোয়েস্ট করতে হয় যা ইমার্জেন্সিতে বিরক্তিকর এবং সময় স্বাপেক্ষ।
০৩. প্রি-পেইড, ডেবিট, ক্রেডিট যে কার্ডই ব্যবহার করেন সিঙ্গেল ট্রানজেকশনে ৩০০ ডলারের বেশি পেমেন্ট করতে পারবেন না। এটা বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ম। করতে হলে কল সেন্টারে ফোন করে কারন বলতে হবে।
০৪. ইবিএল এর ভিসা ক্লাসিক কার্ড পছন্দ হলেও তাদের থেকে মোবাইল এপ এবং সার্ভিসে সিটি ব্যাংক অনেক এগিয়ে আছে। সিটিটাচ অসাধারন ইন্টারফেইসের একটা এপ।
০৫. এমাজনে আমার পেওনিয়ার কার্ড দিয়ে পেমেন্ট করেও একাউন্ট সাসপেন্ড হয়েছিল। যতদুর মনে হয় তারা প্রি-পেইড কার্ড দেখলে বা এই রিজিওন থেকে পেমেন্ট করলে এই সমস্যা করে। এখনো ক্রেডিট কার্ড দিয়ে চেষ্টা করে দেখিনি।
০৬. আলি এক্সপ্রেসে এমেক্স এবং ভিসা দুটোই ব্যবহার করা যায় সমস্যা বাদেই।
০৭. ডলারে পেমেন্ট করার সময় OTP আসে না। তখন আপনার কার্ডের CVV কোড পিনের কাজ করে। এটা এমক্সের সামনের দিকে আর ভিসা বা অন্য কার্ডের পেছন দিকে ছোট করে লেখা থাকে। তাই নিজের কার্ডের ছবি অনলাইনে দেয়ার আগে সাবধান।
০৮. পাসপোর্টে যত রকমের কার্ডই এন্ডোর্স করেন না কেন, মোট এমাউন্ট ১২০০০ ডলারের বেশি হতে পারবে না।