পেপাল আর পেওনিয়ারের পর বাংলাদেশে অনলাইন প্রফেশনাল কমিউনিটির কাছে এখন সব থেকে আলোচিত বিষয় হচ্ছে ওয়াইজ (WISE) একাউন্ট। পূর্বে এর নাম ছিল ট্রান্সফার ওয়াইজ (Transferwise) এবং পরে এটা ওয়াইজ (Wise) হিসেবে রি-ব্রান্ডিং করা হয়।
বাংলাদেশে পেপালের সুবিধা নাই। যারাই আমরা ব্যবহার করি তারা অন্যান্য দেশের হয়ে বা বিজনেস একাউন্ট করে ব্যবহার করি। ওয়াইজ, পেপাল, বা পেওনিয়ার একাউন্টের মধ্যে কার্যত কোন তফাত না থাকলেও গুনগত মান আর সার্ভিসে তফাত আছে। এদের সবগুলোই টাকা ক্রস বর্ডার পেমেন্ট করার জন্য ব্যবহার করা হয়।
পেপালের কথা আগে একটা পোস্টে বলেছি, সেটা নিয়ে এখানে বিস্তারিত বলার কিছু নাই। ইদানিং ফেইসবুক পেইজগুলো ৭০০-১০০০ টাকায় পেপাল একাউন্ট বিক্রি করে। যদিও খুব সহজে আপনি ফ্রিতেই এই একাউন্ট করে নিতে পারেন।
পেওনিয়ার আমাদের দেশে একসময় ত্রাতা হয়ে আসলেও অনেক অনলাইন প্রফেশনালই এখন আর পেওনিয়ারে সার্ভিস পারতপক্ষে ব্যবহার করতে চান না শুধুমাত্র এর চার্জের কারনে।
এরপরে দৃশ্যপটে আসল ওয়াইজ। পেওনিয়ারের মত “বিজনেস টু বিজনেস ট্রানজেকশন ওনলি” -এই ধরনের বাঁধাধরা নিয়ম না থাকার কারনে অতি অল্প সময়েই বাংলাদেশে অনলাইন প্রফেশনালদের কাছে এর গুরুত্ব বেড়ে গেছে অনেক।
প্রথমদিকে অনেক সহজেই একাউন্ট করা গেলেও এখন কিছু ভেরিফিকেশন আর নিয়মে গ্যাড়াকলে পড়তে হচ্ছে নতুন ওয়াইজ ব্যবহারকারীদের। আজকে সেটা নিয়েই আলোচনা করব।
ওয়াইজ পার্সোনাল একাউন্ট
ওয়াইজের দুই ধরনের একাউন্টের মধ্যে পার্সোনাল একাউন্ট যে কেউ খুলতে পারবেন। এখানে পেওনিয়ারের মত অনেক নিয়মের মারপ্যাচে আপনাকে পড়তে হবেনা। এমনকি আপনি অনলাইন প্রফেশনাল না হয়েও শুধুমাত্র বিদেশ থেকে রেমিটেন্স গ্রহন করতে ওয়াইজের একাউন্ট খুলতে পারেন। পেওনিয়ার যেখানে অনলাইন মার্কেটপ্লেসগুলো কে প্রাধান্য দিয়ে তার ব্যবসা প্রসার করেছে, সেখানে ওয়াইজের মূলমন্ত্র হচ্ছে সবার জন্য অনলাইন মানিট্রান্সফার সহজ করা।
![বাংলাদেশ থেকে ওয়াইজ (Wise) একাউন্ট খুলবেন কি করে? 1 বাংলাদেশ থেকে ওয়াইজ (Wise) একাউন্ট খুলবেন কি করে? 1](https://i0.wp.com/bd.blogron.com/wp-content/uploads/2022/03/Wise-Online-Money-Transfers-International-Banking-Features.png?resize=680%2C404&ssl=1)
নিজের খরচের জন্য, ট্রাভেল কিংবা দেশে টাকা পাঠানোর জন্য যে কোন কারনেই হোক না কেন, আপনি খুব সহজেই ওয়াইজ একাউন্ট খুলে টাকা পাঠিয়ে দিতে পারবেন ব্যাংক একাউণ্ট বা বিকাশে। বিকাশে টাকা মূহুর্তের মধ্যেই চলে আসে। ব্যাংকে আসতে কতক্ষন লাগবে সেটা ওয়াইজ নিজেই বলে দেবে। ছুটির দিন না হলে সাধারনত ২৪ ঘন্টার মধ্যেই পেয়ে যাবেন।
সব থেকে মজার জিনিস হল ওয়াইজের ফি অন্যদের তুলনায় অনেক কম। আর এ ব্যাপারে তারা মার্কেটের বেস্ট রেট দেয়ার চেষ্টা করে। আপনি অনেকগুলো কারেন্সিতে আপনার টাকা কনভার্ট করে জমিয়ে রাখতে পারবেন। এবং প্রয়োজনমত সেখান থেকে অন্যদের ওয়াইজ বা ব্যাংক একাউণ্টে টাকা পাঠাতে পারবেন।
প্রথম ধাপঃ ওয়াইজ আসলে ব্যাংকের সুবিধা সংবলিত একটা অনলাইন মানি ট্রান্সফার সিস্টেম। একাউন্ট রেজিস্টার করতে হলে এখানে যান: Wise.com
দ্বিতীয় ধাপঃ একাউন্ট রেজিস্টার করার পর আসবে একাউন্ট ভেরিফাই করার পালা। ভেরিফিকেশনের জন্য আমি সবসময় পাসপোর্ট পছন্দ করি। ঝামেলা বিহীনভাবে যেকোন জায়গায় পাসপোর্ট ইন্টারন্যাশনাল ভেরিফিকেশনে ব্যবহার করা যায়। আপনি চাইলে স্মার্ট এনআইডি কার্ড বা ড্রাইভিং লাইসেন্স দিয়েও ভেরিফাই করতে পারেন। আপনার ডকুমেন্ট আপলোড দিন আর ভেরিফিকেশন কমপ্লিট হবার জন্য অপেক্ষা করুন।
তৃতীয় ধাপঃ এই পর্যায়ে আপনার ওয়াইজ একাউন্টে ব্যাংক ডিটেইলস পাবার জন্য কিছু ডলার বা পাউন্ড জমা করতে হবে। এই জমাকৃত টাকা আপনি আবার পরে উত্তোলন বা ব্যবহার করতে পারবেন। নিজের নামে যদি কোন ইন্টারন্যাশনাল ডেবিট বা ক্রেডিট কার্ড থাকে তবে সেটা দিয়ে এই টাকা জমা করতে পারবেন। অন্যকোন ওয়াইজ ইউজার এর কাছ থেকে ফান্ড ট্রান্সফার করেও এই ভেরিফিকেশন করতে পারবেন।
মনে রাখবেন, বাংলাদেশের ক্রেডিট বা ডেবিট কার্ড দিয়ে এই টাকা লোড করা যায় না, সেটা ডুয়েল কারেন্সি এবং এন্ডোর্স্মেন্ট করা থাকলেও। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে এটি বন্ধ করা আছে।
আপনি পেওনিয়ার মাস্টারকার্ড দিয়ে ডলার লোড করতে পারবেন না। ওয়াইজ অথবা পেওনিয়ার কেউ একজন এই ধরনের ডলার ট্রানজেকশন এলাউ করে না। তবে অনেক ব্যবহারকারী বলেছেন তারা পেওনিয়ার কার্ড দিয়ে ডলারের পরিবর্তে পাউন্ড লোড দিতে পেরেছেন ভেরিফিকেশনের জন্য।
আমি যদিও ভেরিফিকেশনের জন্য কোন টাকা লোড দেইনি। পাসপোর্ট আপলোড করার পরে ওয়াইজের মোবাইল এপে গিয়ে একাউন্ট ডিটেইলস পেয়ে গিয়েছিলাম। এই পদ্ধতি এখনও কাজ করে কিনা জানি না।
ভার্চুয়াল কার্ড দিয়ে পেমেন্ট করলে অনেক সময় একাউন্ট খোলার আগেই ব্লক করে দেয়। সবথেকে ভালো হয় আপনি আগে ডলার/পাউন্ড লোড করে ভেরিফিকেশন করবেন পরে নিজের কাগজ-পত্র আপলোড করবেন। তাতে সুবিধা হবে টাকা লোড না হলে বা একাউন্ট বন্ধ হয়ে গেলে আবার নতুন একাউন্ট খুলতে পারবেন।
ওয়াইজ পার্সোনাল একাউন্ট খুলতে এখানে যান: Wise.com
ওয়াইজ বিজনেস একাউন্ট
![বাংলাদেশ থেকে ওয়াইজ (Wise) একাউন্ট খুলবেন কি করে? 2 বাংলাদেশ থেকে ওয়াইজ (Wise) একাউন্ট খুলবেন কি করে? 2](https://i0.wp.com/bd.blogron.com/wp-content/uploads/2022/03/wise.png?resize=680%2C354&ssl=1)
একাউন্ট রেজিস্টার করার সময় দেখবেন বিজনেস (Business) বলে একটা অপশন আছে। পার্সোনাল ওয়াইজ একাউন্ট এ বিজনেস লেনদেন করা যায় না। এর কারনে অনেকে সময়ই একাউন্ট বন্ধ করে দেয়া হয়। আপনি যদি ফ্রি-ল্যান্সার হয়ে থাকেন এবং মার্কেটপ্লেসের বাইরে একাধিক ক্লায়েন্টের কাছ থেকে প্রতি মাসে ভিন্ন ভিন্ন পরিমানের অর্থ নিয়ে থাকেন, তবে আপনার দরকার একটা বিজনেস একাউন্ট।
ব্যাক্তিগত একাউন্টের মতই বিজনেস একাউন্ট খুলতে পারবেন, শুধু ভেরিফিকেশন আলদাভাবে হবে। এর জন্য আপনার একটা লিমিটেড বিজনেস বা রেজিস্টার্ড অন্য বিজনেস থাকা আবশ্যক। আমি ব্যাক্তিগত একাউন্ট করার পরে বাংলাদেশী ট্রেড লাইসেন্স দিয়ে বিজনেস একাউন্ট করতে গিয়ে ব্যার্থ হয়েছি 🙂 কারন বাংলাদেশের ট্রেড লাইসেন্স তারা এলাউ করে না।
বিজনেস একাউন্ট খোলার সবচেয়ে সহজ পদ্ধতি হল আপনি US অথবা UK তে একটা LTD কোম্পানি ফর্ম করবেন প্রথমে। সেই কোম্পানির ডিটেইলস দিয়ে আপনি খুব সহজেই ওয়াইজের বিজনেস একাউন্ট খুলে ফেলতে পারবেন।
সব থেকে সহজ হয় UK LTD কোম্পানি খুলে ফেললে। এটার খোলার খরচ আর মেইনটিনেন্স অনেক কম। ফেইসবুকে একটু ঢু মারলেই দেখবেন অনেক চটকদার বিজ্ঞাপন আছে যারা UK LTD কোম্পানি খুলে দিচ্ছে একটা ফি নিয়ে। আমি এদের উপর হতাশ হয়েছে এদের চড়া ফি দেখে। আদতে একটা ইউকে কোম্পানি খুলতে আপনার ৫০ পাউন্ডের বেশি লাগার কথা না। এটা নির্ভর করে আপনি কি ধরনের কোম্পানি খুলবেন তার উপর।
আপনার যদি একটা পেওনিয়ার কার্ড থাকে বা বাংলাদেশী অন্য ডুয়েল কারেন্সী ডেবিট বা ক্রেডিট কার্ড থেকে থাকে তবে এটা আপনি নিজেই করতে পারবেন।
ইউকে কোম্পানি খুলে ওয়াইজের বিজনেস একাউন্ট নেবার জন্য যে জিনিসগুলো আপনার দরকারঃ
০১. UK LTD কোম্পানি রেজিস্ট্রেশন করে দেবে এরকম একটা কোম্পানি
০২. একটা ডুয়েল কারেন্সি কার্ড
০৩. ভ্যালিড পাসপোর্ট
০৪. ব্যাংক স্টেটমেন্ট
আমি সাজেস্ট করব যে দুটো কোম্পানি তারা হলোঃ
০১. 1stformations.co.uk
০২. qualitycompanyformations.co.uk
লিমিটেড কোম্পানির জন্য আপনাকে নূন্যতম প্রাইভেসি প্যাকেজটি নিতে হবে। এই প্যাকেজেই আপনি রেজিস্টার্ড অফিস এড্রেস, বিজনেস এড্রেস, ডিরেক্টরস এড্রেস এবং বাদ বাকি বিজনেস ডকুমেন্টস পেয়ে যাবেন। আপনার ভেরিফিকেশনের জন্য তারা পাসপোর্ট এবং ব্যাংক ডকুমেন্টস চাইবে। বিস্তারিত তাদের সাইটে গিয়ে পড়ে এবং বুঝে নিন। সাপোর্ট অনলাইন থাকে সবসময়ই। গুগল করলে আরো অনেক সার্ভিস পাবেন যারা এই কোম্পানি খুলতে সাহায্য করে। না বুঝতে পারলে কমেন্ট বক্সে বা ব্লগরনের ফেইসবুক পেইজে জিজ্ঞেস করুন।
মোটামুটিভাবে চার থেকে পাঁচ দিনের মাঝেই আপনি একটা রেজিস্টার্ড কোম্পানি পেয়ে যাবেন GOV.UK সাইটে। এর পর বিজনেস একাউন্ট খুলে ফেলুন সেই তথ্যগুলো দিয়ে ওয়াইজে।
চাইলে আপনি বিজনেস একাউন্টের জন্য আলাদা ইমেইল এড্রেস ব্যবহার করতে পারেন অথবা আপনার পার্সোনাল একাউন্ট যেই ইমেইলে আছে সেটা দিয়েও বিজনেস একাউন্ট খুলতে পারবেন। সেক্ষেত্রে আপনি লগিন করার পর চুজ করতে পারবেন কোন একাউন্টের ডিটেইলস দেখতে চান। একজনের একটাই পার্সোনাল ওয়াইজ একাউন্ট থাকবে, কিন্তু একাধিক বিজনেস প্রোফাইল বা একাউন্ট থাকতে পারে।
যদি পার্সোনাল একাউন্ট আগেই ভেরিফাই করা থাকে তবে নতুন করে ডকুমেন্ট আপলোড নাও করতে হতে পারে। তবে ভেরিফিকেশনের জন্য সেই ২০ পাউণ্ড লোড করতে হবে।
মনে রাখবেন, এখানেও পেওনিয়ার বা বাংলাদেশী কোন ব্যাংক থেকে ইস্যু করা ডুয়েল কারেন্সি কার্ড কাজ করবে না। এমনকি আপনি আপনার পার্সোনাল একাউন্ট থেকে বিজনেস একাউন্টেও মানি ট্রান্সফার করতে পারবেন না।
আমি আমার নামে ইস্যু করা মালয়েশিয়ান প্রিপেইড ভিসা কার্ড দিয়ে এই পেমেন্ট করেছি। আদতে উঠতি ফ্রি-ল্যান্সারদের এই বিজনেস একাউন্টে যাবার ঝামেলা করারই দরকার নেই।
সবকিছু ঠিকঠাকমত পূরন করতে পারলে মাত্র একদিনেই আপনার বিজনেস একাউন্ট এপ্রুভ হয়ে যাবে। এপ্রুভ হয়ে যাবার পর আপনি আপনার বাংলাদেশের ঠিকানায় ওয়াইজের বিজনেস ভিসা কার্ড অর্ডার করতে পারবেন। সেই সাথে বিজনেস একাউণ্টের আর বাদ বাকি সুবিধাও ভোগ করতে পারবেন।
বিজনেস একাউন্টে লেনদেনের লিমিট বেশি, ভার্চুয়াল কার্ড তৈরি করা যায়, ফিজিক্যাল ভিসা কার্ড পাওয়া যায়। টিম মেম্বারদের জন্যও কার্ড অর্ডার করা যায়।
বিজনেস একাউন্ট না থাকলে বাংলাদেশে ওয়াইজের ভিসা কার্ড পাবেন না। আমি কার্ড অর্ডার করার ৯ দিনের মাথায় পোস্টালে বাংলাদেশে কার্ড রিসিভ করেছি।
![বাংলাদেশ থেকে ওয়াইজ (Wise) একাউন্ট খুলবেন কি করে? 3 বাংলাদেশ থেকে ওয়াইজ (Wise) একাউন্ট খুলবেন কি করে? 3](https://i0.wp.com/bd.blogron.com/wp-content/uploads/2022/03/wise-business-visa-card.jpg?resize=680%2C326&ssl=1)
তো এবার দেখা যাক কে কোথায় সমস্যায় পড়ছেন আর সেগুলো কি কি?